Description
উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় নাটক নিয়ে কিছু বলার আগে ব্যক্তি উজ্জ্বল সম্পর্কে দু-চার কথা বলা জরুরি, তাতে তার নাট্য বিশ্লেষণ অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমার মনে হয়েছে, উজ্জ্বলের সব থেকে বড় গুণ ওঁর মাটির প্রতি ভালোবাসা, শিকড়ের প্রতি টান এবং লোকজীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তার গ্রাম লাভপুরের কৃতি কথাকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবহেলিত ভিটের পুনরুদ্ধার, লোকসংস্কৃতি উৎসবের ধারাবাহিক আয়োজন কিংবা লোকশিল্পীদের সঙ্গে নিয়ত যোগাযোগ- এটাই প্রমাণ করে, যে আসলে সে গ্রাম, গ্রামের মানুষ, গ্রামের মাটিকে বড়ো ভালোবাসে। তার প্রতিটি নাটকে আছে এই ভালোবাসারই ছাপ।
লোকনাট্য সংকলনের প্রথম নাটক ধর্মমঙ্গল। মঙ্গলকাব্য নিয়ে (মুখ্যত মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল) বাংলায় অসংখ্য নাট্য নির্মাণ হলেও ধর্মমঙ্গলের পূর্ণাঙ্গ নাট্যরূপ এই প্রথম। এক্ষেত্রে নাট্যকার ইতিহাস তৈরি করেছেন। এর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল ধর্মমঙ্গলের অলৌকিকতাকে প্রতীকের মাধ্যমে উপস্থাপিত করে মধ্যযুগের কাহিনিকে সমকালীন বা চিরকালীন করার প্রয়াস। সর্বোপরি বহুরূপী, ঘোড়ানাচ, রণপা, রাইবেশে, বাউল প্রভৃতি রাঢ় সংস্কৃতিকে একটি নাটকে নিয়ে এসে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন উজ্জ্বল।
ধর্মমঙ্গল ছাড়া বাকি চারটি নাটক স্বল্প দৈর্ঘ্যের এবং বলা বাহুল্য সবগুলোতেই লোকজীবনের বিভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। বোগলো বায়ের নাটকে আছে এক বৃদ্ধ ঢাকির একচিলতে জীবনের প্রতিচ্ছবি। যে চায় অন্ধ ছেলে হরি তার বংশের ঢাক কঁাধে করবে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম তো শিকড় ছিড়ে নাগরিক জীবনে ছুটছে। তবু হতাশা নয়, প্রত্যাশাই তো আমাদের অবলম্বন। তাই হরির ছেলে বশীর কাধে বেজে ওঠে তার দাদুর স্বপ্নের জয়ঢাক। নাটকে ঢাকের নি ছাড়াও আছে ভাঁজা ও ভাদুর গান।
‘নাগিনী কন্যার কাহিনি’ তারাশঙ্করের সুবিখ্যাত উপন্যাসকে উপজীব্য করে লেখা। হিজল বিলের চরায়, হারমুখীর ধারে বাস করা বেদে সমাজের নাগিনী কন্যা পিঙ্গলার জীবনে তো একটাই দ্বন্দ্ব- সে নারী না নাগিনী ? নাটকে একাধিকবার বাবহত হয়েছে মনসামঙ্গলের গান। পিঙ্গলার মতোই। একই দ্বন্দ্বে জর্জরিত নজর’ নাটকের ফুলমনিয়া। তার নিজের প্রশ্ন সে ডাইনি না নারী? পিঙ্গলার মতোই সেও এর উত্তর খুঁজে পায় জীবনের বিনিময়ে। এ নাটক আদিবাসী জীবন নির্ভর, তাই সাঁওতালি নাচ-গান এ নাটকের প্রাণ।
অলৌকিক এক অন্য ধারার মনস্তাত্ত্বিক নাটক। গঙ্গার ঘাটে শ্মশানে মৃতা কন্যা সরস্বতীর সঙ্গে সুখ-দুখের গল্প করে কাটায় ভোলা। স্ত্রী এবং সংসারে আর সে ফিরে যেতে চায় না। নিশি ডোমের কথায় শ্ৰম ভুলে স্ত্রী সতীর কাছে। ফিরে গেলেও অদৃশ্য শ্মশানচারিণী কন্যার পিছুডাক সে অস্বীকার করে কীভাবের নাটকে আছে শ্মশান যাত্রার বিভিন্ন সুরে হরিনামের গান।
ভালোলাগার বিষয়, লোকনাট্য সংকলনের পাঁচালি নাটকই বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর প্রযোজনায় অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়েছে বা বলা ভালো হয়ে চলেছে। দিল্লি ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার ছাত্র অভিনেতা এবং অধ্যাপক সারা ভারতের বিভিন্ন আঙ্গিকের নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এই নাটকগুলিতে বঙ্গমাটির গন্ধ লেগে আছে, আছে বাংলার বিচিত্র লোকসংস্কৃতির স্বতন্ত্র পরিচয়। | নাটকগুলি বাংলা নাটকেরা পাঠক, দর্শক তথা লোকজীবন নির্ভর কাজ করতে আগ্রহ নাট্যদলকে যে সমৃদ্ধ করবে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
সুচিপত্র/ চরিত্রলিপি
• ধর্মমঙ্গল :
চরিত্র : মহামদ, পুরোহিত, রঞ্জাবতী, কর্ণসেন, মূল গায়েন ও বাউল দল, লাউসেন, হনুমান, দুত, কালু ডোম ও সম্প্রদায় মন্ত্রী, সৈন্য, দেবপাল, কামদল, সুরীক্ষা, কামরুপরাজ, কলিঙ্গা, মালিনী, সখী, কানাড়া, প্রজাকুল।
• বোগলো বায়েন :
চরিত্র : সন্ধ্যা, হরি, আদুরি, বোগলো, বংশী, বোগলের বউ, মূল গায়েন,ভানু গানের দল, বহুরূপী
• নজর :
চরিত্র : আজমিরা, মৌলবী, ফুলমনি, রহম, গ্রামবাসী ও মোড়ল, সুবল কাকা, হারা, তারো
• নাগিনী কন্যার কাহিনি:
চরিত্র : শিরবেদে, ভাদু, ধনন্তরী, নাগুঠাকুর, নাগিনী কন্যা, বেদেনি, বেদের দল
• অলৌকিক:
চরিত্র : নিশি, সতী, ভোলা, সরো, নিতাই, কালুয়া, শিল্পী, হরিনামের দল
Reviews
There are no reviews yet.