Description
সিঙ্গুর অতীতে সিংহপুর নামে পরিচিত ছিল। প্রাচীনকালে সরস্বতী নদীর তীরে অবস্থিত সিংহপুর ছিল রাজা সিংহবাহুর রাজধানী। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে মহারাজা সিংহবাহু এখানে রাজত্ব করেছেন। সিংহল (শ্রীলঙ্কা) দেশের দুটি প্রাচীন গ্রন্থ ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ’ থেকে জানা যায়, সিংহবাহুর পুত্র বিজয়সিংহ অত্যন্ত দুর্বিনীত আচরণের জন্য সাতশত অনুচর সহ তাকে বঙ্গ দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। অতপর বিজয় সিংহ সরস্বতী নদীর বুকে নৌকা ভাসিয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দর হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সিংহল দ্বীপে পৌঁছায়। সিংহল দেশ জয় করে সেখানকার রাজা হন ৷
পর্তুগিজরা বাণিজ্য-তরী নিয়ে সপ্তগ্রাম বন্দরে আসার পথে দীর্ঘপথের ক্লান্তি নিরসনের জন্য সরস্বতী নদীর তীরে বাসা নামক স্থানে একটি ছোট বন্দর স্থাপন করে। এই বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে নোঙর করে বণিকরা কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতেন। পণ্ডিতগণের অনেকে মনে করেন, ‘বাকসা” শব্দটি পর্তুগিজ শব্দ ‘বজরা’-র অপভ্রংশ।
সরস্বতী নদীর বুকে নৌকা ভাসিয়ে শ্রীমন্ত সওদাগর বাণিজ্য করতে যাওয়ার পথে চণ্ডীতলা নাম স্থানে চণ্ডীদেবীর ঘট স্থাপন করে দেবীর পূজা করেন। চণ্ডীবিগ্রহের নামানুসারে জায়গাটির এইরূপ নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কালক্রমে সরস্বতী নদী তার অতীত গৌরব হারালেও দেবীচন্ডী এ অঞ্চলের জনমানসে জাগ্রত দেবীর ভূমিকায় আজও অধিষ্ঠিতা ।
একটা সময় সরস্বতীর জলপ্রবাহ ক্রমশ কমে আসে। ফলে বড়-বড় বাণিজ্য জাহাজগুলো সপ্তগ্রাম বন্দরে পৌঁছাতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হত। এই কারণে বণিকরা নদীর মোহনার দিকে বেতড় গ্রামে অস্থায়ীভাবে বন্দর গড়ে তোলে। বেতড় বন্দরে জাহাজগুলোকে নোঙর করে ছোট জলযানে সমস্ত পণ্য তুলে সপ্তগ্রাম বন্দরে পৌঁছানো হত। বর্তমানে বেতড় গ্রাম থেকে সরস্বতী নদী বহুদূরে সরে গেছে। বেতড় গ্রামটি বর্তমানে হাওড়ার দক্ষিণ অংশে ব্যাঁটরা নামে পরিচিত।
ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সরস্বতী নদীর মুখে চড়া পড়তে শুরু করে। সরস্বতীর জলপ্রবাহ দিন-দিন কমে আসে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে সরস্বতীর নাব্যতা একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে, বড় বড় পণ্যবাহি জাহাজগুলো সপ্তগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। সরস্বতী নদী ক্রমশ শীর্ণ হয়ে যাওয়ায় গঙ্গার মূলস্রোত সরস্বতী বরাবর প্রবাহিত না হয়ে ভাগীরথী দিয়ে বইতে শুরু করে। এই সময় ১৫৮০ সালে পর্তুগিজরা দিল্লির সম্রাট আকবরকে বহু উপঢৌকন দিয়ে সন্তুষ্ট করে হুগলিতে উপনিবেশ স্থাপনের একখানা ফরমান সংগ্রহ করে নেয়। এরপর ব্যবসার সুবিধার্থে তারা ভাগীরথীর তীরে হুগলি নামক স্থানে গড়ে তোলে হুগলি বন্দর। সরস্বতী নদীকে পরিত্যাগ করে দেশী-বিদেশী বণিকরা ভাগীরথী দিয়ে বাণিজ্য-জাহাজ নিয়ে হুগলি বন্দরে ভিড় জমায়। ফলস্বরূপ সপ্তগ্রামের বহির্বাণিজ্য একেবারে ভেঙে পড়ল। আর সপ্তগ্রাম বন্দরের পতনের সাথে সাথে সরস্বতী নদী তার গৌরব হারায়।
বঙ্গদেশের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ জেলা হিসাবে হুগলির খ্যাতি বহু প্রাচীন । জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজস্র ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান, দর্শনীয় ও ধর্মীয় প্রাচীন সৌধ। জেলার পথে ঘাটে ঘুরে মানুষের সাথে মিশে লেখক ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধান করেছেন। ঐতিহাসিক বিভিন্ন তত্ত্ব ও নথিভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে পরিচিত তথ্যগুলোকে ইতিহাসের সাথে সাহিত্য যোগ করে লেখক নতুন আঙ্গিকে দেখানোর প্রয়াস করেছেন। এতে ইতিহাস আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এই গ্রন্থে স্বল্প পরিসরের মধ্যে জেলার পরিচিতি, আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা, ঐতিহাসিক সরস্বতী নদী, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনালেখ্য, স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান, মন্দির মসজিদ গীর্জার পুরাকীর্তিসম্বলিত দর্শনীয় স্থান, সাহিত্য-সংস্কৃতির কিছু পরিচয় তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটি সচেতন পাঠক ও গবেষক মহলে সমাদৃত হবে আশা করা যায়।
Reviews
There are no reviews yet.