#পাঠ_প্রতিক্রিয়া
হারেম- শ্রীপান্থ – দে’জ পাবলিশার্স
মুদ্রিত মূল্য- ১৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা- ১১২
ইতিহাস বরাবরই আমাকে ভীষণ টানে। যেখানেই ইতিহাসের গন্ধ পাই একদম লুফে নেওয়ার চেষ্টা করি। পাঠ্য বইতে আগে কয়েকবার ‘হারেম’ শব্দটির উল্লেখ পেয়েছি। তখন শুধু জানতাম এটি নারীকেন্দ্রিক কিছু, তবে এর বেশি আর কিছুই জানতাম না। এই গ্রুপ থেকেই ‘হারেম’ বইটির কথা জানতে পারি। ব্যাস্ দেরি না করে কিনে ফেলি বইটি এবং পড়েও ফেলি। এবার আসি বিষয়বস্তুতে।
প্রকৃত অর্থে ‘হারেম’ কি? “তুর্কী সুলতানেরা তাঁদের অন্দরমহলের নাম দিয়েছিলেন হারেম। পারস্যে ওঁরা বলতেন অন্দরম। ভারতবর্ষে অন্তঃপুর। পরবর্তীকালে কেউ কেউ জেনানাও বলতেন। পারসিক ‘জান’ শব্দের অর্থ মহিলা। সেই থেকেই জেনানাখানা বা জেনানা।” হারেম বলতে সাধারণত বোঝায় নিষিদ্ধ এলাকা। যেখানে প্রাসাদের বেগম, বিবি, বাঁদীরা থাকতো। সুলতান – বাদশা ছাড়া অন্য কোনো সবল পুরুষের প্রবেশ সেখানে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র খোজারাই প্রবেশ করতে পারতো সেই নিষিদ্ধপুরীতে।
হারেমে অনেক মেয়েদের যেমন জোরপূর্বক আনা হতো, তেমনই অনেকে স্বেচ্ছায়ও চলে আসতো। আবার অনেক পিতা-মাতা অথবা স্বামীরা তাদের মেয়েদের বা স্ত্রীদের বেচে দিতো এই হারেমে। কিন্তু কেন বেচে দিতো তারা এইভাবে? কারণ হারেম ছিল সুখের স্বর্গ। দেশের অন্যত্র দুর্ভিক্ষ দেখা দিলেও হারেমে খাদ্যাভাব হতো না। সেখানে আমোদ – প্রমোদ, সর্বোপরি সুখের কোনো কমতি ছিল না।
হারেমে অফুরন্ত আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল। মোঘল আমলে হারেমের মেয়েরা দাবা খেলা, তাস-পাশা খেলার পাশাপাশি পোলো অবধি খেলতো। এমনকি হারেমে বিদ্যাচর্চাও হতো। নির্দিষ্ট রীতি মেনে ছাত্রী জীবন কাটাতে হতো প্রতিটি নবাগত মেয়েকে।
হারেমের বিশাল রসুইখানা ছিল। সেখানে সু-অভিজ্ঞ পাচক ছিল দেড়শো জন। তার অধীনে ছিল পঞ্চাশ জন সহকারী। আবার মিঠাই কারীগরদের সহকারী ছিল আরও তিরিশ জন। আর খাবার চেখে দেখার জন্য ছিল আরও একশো জন। প্রতিদিন দুশো গাড়ি জ্বালানি লাগতো হারেমের উনুনগুলোর জন্য। তুরস্কের হারেমের দৈনিক ফর্দ ছিল বেশ আকর্ষণীয়। ফর্দে ছিল:-
কচি ভেড়া— ২০০
ভেড়া— ১০০
বাছুর— ৪
রাজহাঁস— ৪ জোড়া
মোরগ— ১০০ জোড়া
মুরগী— ১০০ জোড়া
পায়রা— ১০০ জোড়া
এছাড়াও দৈনিক খাদ্যতালিকায় থাকতো পোলাও, মিঠাই, সরবত, বরফ ইত্যাদি। মুঘল হারেমে সোনার দন্ড স্থাপিত চীনে মাটির পাত্রে খাদ্য সরবরাহ করা হতো। বাদশাহের মতো বেগমরাও খেতেন সোনার পাত্রে।
হারেমের আর এক আকর্ষণীয় দিক ছিল হামাম অর্থাৎ স্নানঘর। মুঘল আমলে রূপসীরা যে স্বচ্ছ টলটলে নীল জলে ভাসতো তা বয়ে আনা হতো যমুনার থেকে। আবার তুর্কী সাম্রাজ্যের হামাম ছিল চারিদিকে ফোয়ারা আর জলাধার দ্বারা বেষ্টিত। জলের নলগুলো সব সোনা আর রূপোয় গড়া। পাত্রগুলিও সোনো – রূপোয় খচিত। কোনো কোনো পাত্রে একই সঙ্গে ঠান্ডা ও গরম জল আসতো।
হারেমের এই উজ্জ্বল রূপটির পেছনে কিন্তু অন্ধকার রূপও ছিল। হারেমে দেখাশোনা করার জন্য প্রয়োজন হতো খোজার। খোজা অর্থাৎ বন্ধ্যাত্ব পুরুষ। লেখকের ভাষায় এরা ছিল লোভাতুর, উদ্বিগ্ন, অক্ষম রাজা বাদশাহদের মনোবিকারের ফল মাত্র। এই খোজাদের কোথা থেকে আনা হতো, তাদের কিভাবে খোজা বানানো হতো তার বিবরণ পাওয়া যায় এই বইটিতে।
হারেম যদি কান্নার ইতিবৃত্ত হয়, তবে খোজা ছিল তার আর্তনাদ। খোজা করার জন্য একবার তিরিশ হাজার পুরুষকে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল, যার মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র তিন হাজার।
হারেমে ষড়যন্ত্রও কিন্তু কিছু কম হতো না। চতুর্থ মুরাদ আর ইব্রাহিমের মা কুসুম (বইতে লেখক সকলের সুবিধার্থে ‘কুসুম’ নাম ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তার আসল নাম ছিল ‘কিউসেম’), যে একসময় তুর্কী সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী ছিলেন, তাকে রাজদরবারে বিবস্ত্র করে হত্যা করা হয়েছিল ষড়যন্ত্রের কারণেই। এই ষড়যন্ত্রের কারণেই তুর্কী হারেমে একসঙ্গে তিনশো জীবন্ত মেয়েকে জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। এছাড়া কেউ কেউ সুলতানের প্রিয় হয়ে উঠলে তাকে কিভাবে কৌশলে হত্যা করা হতো তার বিবরণও পাওয়া যায় এই বইটিতে।
এই বইটিতে তুর্কী সুলতান, মুঘল সম্রাটদের পাশাপাশি লখনউ অথবা অযোধ্যার নবাব, মুর্শিদাবাদের নবাব, বিজয়নগরের হিন্দু রাজাদের কথাও উঠে এসেছে।
এছাড়া বইটিতে আরও অনেক তথ্য আছে। বইটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। হারেম সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল এই বই থেকে। এককথায় সমৃদ্ধ হলাম।
Susmita Basak –
#পাঠ_প্রতিক্রিয়া
হারেম- শ্রীপান্থ – দে’জ পাবলিশার্স
মুদ্রিত মূল্য- ১৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা- ১১২
ইতিহাস বরাবরই আমাকে ভীষণ টানে। যেখানেই ইতিহাসের গন্ধ পাই একদম লুফে নেওয়ার চেষ্টা করি। পাঠ্য বইতে আগে কয়েকবার ‘হারেম’ শব্দটির উল্লেখ পেয়েছি। তখন শুধু জানতাম এটি নারীকেন্দ্রিক কিছু, তবে এর বেশি আর কিছুই জানতাম না। এই গ্রুপ থেকেই ‘হারেম’ বইটির কথা জানতে পারি। ব্যাস্ দেরি না করে কিনে ফেলি বইটি এবং পড়েও ফেলি। এবার আসি বিষয়বস্তুতে।
প্রকৃত অর্থে ‘হারেম’ কি? “তুর্কী সুলতানেরা তাঁদের অন্দরমহলের নাম দিয়েছিলেন হারেম। পারস্যে ওঁরা বলতেন অন্দরম। ভারতবর্ষে অন্তঃপুর। পরবর্তীকালে কেউ কেউ জেনানাও বলতেন। পারসিক ‘জান’ শব্দের অর্থ মহিলা। সেই থেকেই জেনানাখানা বা জেনানা।” হারেম বলতে সাধারণত বোঝায় নিষিদ্ধ এলাকা। যেখানে প্রাসাদের বেগম, বিবি, বাঁদীরা থাকতো। সুলতান – বাদশা ছাড়া অন্য কোনো সবল পুরুষের প্রবেশ সেখানে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র খোজারাই প্রবেশ করতে পারতো সেই নিষিদ্ধপুরীতে।
হারেমে অনেক মেয়েদের যেমন জোরপূর্বক আনা হতো, তেমনই অনেকে স্বেচ্ছায়ও চলে আসতো। আবার অনেক পিতা-মাতা অথবা স্বামীরা তাদের মেয়েদের বা স্ত্রীদের বেচে দিতো এই হারেমে। কিন্তু কেন বেচে দিতো তারা এইভাবে? কারণ হারেম ছিল সুখের স্বর্গ। দেশের অন্যত্র দুর্ভিক্ষ দেখা দিলেও হারেমে খাদ্যাভাব হতো না। সেখানে আমোদ – প্রমোদ, সর্বোপরি সুখের কোনো কমতি ছিল না।
হারেমে অফুরন্ত আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা ছিল। মোঘল আমলে হারেমের মেয়েরা দাবা খেলা, তাস-পাশা খেলার পাশাপাশি পোলো অবধি খেলতো। এমনকি হারেমে বিদ্যাচর্চাও হতো। নির্দিষ্ট রীতি মেনে ছাত্রী জীবন কাটাতে হতো প্রতিটি নবাগত মেয়েকে।
হারেমের বিশাল রসুইখানা ছিল। সেখানে সু-অভিজ্ঞ পাচক ছিল দেড়শো জন। তার অধীনে ছিল পঞ্চাশ জন সহকারী। আবার মিঠাই কারীগরদের সহকারী ছিল আরও তিরিশ জন। আর খাবার চেখে দেখার জন্য ছিল আরও একশো জন। প্রতিদিন দুশো গাড়ি জ্বালানি লাগতো হারেমের উনুনগুলোর জন্য। তুরস্কের হারেমের দৈনিক ফর্দ ছিল বেশ আকর্ষণীয়। ফর্দে ছিল:-
কচি ভেড়া— ২০০
ভেড়া— ১০০
বাছুর— ৪
রাজহাঁস— ৪ জোড়া
মোরগ— ১০০ জোড়া
মুরগী— ১০০ জোড়া
পায়রা— ১০০ জোড়া
এছাড়াও দৈনিক খাদ্যতালিকায় থাকতো পোলাও, মিঠাই, সরবত, বরফ ইত্যাদি। মুঘল হারেমে সোনার দন্ড স্থাপিত চীনে মাটির পাত্রে খাদ্য সরবরাহ করা হতো। বাদশাহের মতো বেগমরাও খেতেন সোনার পাত্রে।
হারেমের আর এক আকর্ষণীয় দিক ছিল হামাম অর্থাৎ স্নানঘর। মুঘল আমলে রূপসীরা যে স্বচ্ছ টলটলে নীল জলে ভাসতো তা বয়ে আনা হতো যমুনার থেকে। আবার তুর্কী সাম্রাজ্যের হামাম ছিল চারিদিকে ফোয়ারা আর জলাধার দ্বারা বেষ্টিত। জলের নলগুলো সব সোনা আর রূপোয় গড়া। পাত্রগুলিও সোনো – রূপোয় খচিত। কোনো কোনো পাত্রে একই সঙ্গে ঠান্ডা ও গরম জল আসতো।
হারেমের এই উজ্জ্বল রূপটির পেছনে কিন্তু অন্ধকার রূপও ছিল। হারেমে দেখাশোনা করার জন্য প্রয়োজন হতো খোজার। খোজা অর্থাৎ বন্ধ্যাত্ব পুরুষ। লেখকের ভাষায় এরা ছিল লোভাতুর, উদ্বিগ্ন, অক্ষম রাজা বাদশাহদের মনোবিকারের ফল মাত্র। এই খোজাদের কোথা থেকে আনা হতো, তাদের কিভাবে খোজা বানানো হতো তার বিবরণ পাওয়া যায় এই বইটিতে।
হারেম যদি কান্নার ইতিবৃত্ত হয়, তবে খোজা ছিল তার আর্তনাদ। খোজা করার জন্য একবার তিরিশ হাজার পুরুষকে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল, যার মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র তিন হাজার।
হারেমে ষড়যন্ত্রও কিন্তু কিছু কম হতো না। চতুর্থ মুরাদ আর ইব্রাহিমের মা কুসুম (বইতে লেখক সকলের সুবিধার্থে ‘কুসুম’ নাম ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তার আসল নাম ছিল ‘কিউসেম’), যে একসময় তুর্কী সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী ছিলেন, তাকে রাজদরবারে বিবস্ত্র করে হত্যা করা হয়েছিল ষড়যন্ত্রের কারণেই। এই ষড়যন্ত্রের কারণেই তুর্কী হারেমে একসঙ্গে তিনশো জীবন্ত মেয়েকে জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। এছাড়া কেউ কেউ সুলতানের প্রিয় হয়ে উঠলে তাকে কিভাবে কৌশলে হত্যা করা হতো তার বিবরণও পাওয়া যায় এই বইটিতে।
এই বইটিতে তুর্কী সুলতান, মুঘল সম্রাটদের পাশাপাশি লখনউ অথবা অযোধ্যার নবাব, মুর্শিদাবাদের নবাব, বিজয়নগরের হিন্দু রাজাদের কথাও উঠে এসেছে।
এছাড়া বইটিতে আরও অনেক তথ্য আছে। বইটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। হারেম সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল এই বই থেকে। এককথায় সমৃদ্ধ হলাম।