Description
কি এমন আছে এই গল্পে, যা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাসে টেনে নিয়ে যায় পাঠককে? একটু আলোকপাত করি। গল্পের প্রথম পর্বটুকু বাদ দিলে, দ্বিতীয় পর্বেই ঘটে যায়, একটি বিস্ফোরণ। তাও আবার হাওড়া স্টেশনের মত জনবহুল স্থানে। যে বিস্ফোরণে একটি মোবাইল ফোনকে রিমোটের মত ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই বিস্ফোরণের পিছনে ছিল,আরো বড় ষড়যন্ত্র, যার চিরুনি তল্লাশি করতে গিয়ে গল্প কখনো পৌঁছে গেছে উড়িষ্যার চন্ডকা গ্রামে মাওবাদী জনগোষ্ঠীর কর্মকান্ডে, কখনো বা রাজ্যের রাজনৈতিক নেতাদের লাল কার্পেটের নীচে লুকিয়ে থাকা স্বার্থপর অভিসন্ধির গোড়ায়। কিন্তু গল্প যেভাবেই এগিয়ে যাক না কেন, তার গতিময়তা আর বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ গল্পকে অদ্ভুত ভাবে বেঁধে রেখেছে পাঠকের মনোযোগের সাথে। গল্পের চরিত্রচিত্রণকে বাস্তব রূপ দিতে, লেখক কিছু কিছু জায়গায় তাদের হাব ভাব,চাল চলন ও কথনে যে ধরণের সংলাপ ব্যবহার করেছেন, হয়ত তা পরিশীলিত নয় তবু তা প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে। বর্ণনামূলক লেখাতেও চরিত্র চিত্রণ করা যেত হয়ত, কিন্তু সংলাপ এখানে এক বড় ধরণের চিত্রশৈলী হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে বলি, বেশ কয়েক বছর আগে সাংবাদিক মধুময় পালের ‘ আলিঙ্গন দাও রানী’ নামের একটি উপন্যাস পড়েছিলাম, যেখানে দারিদ্র্যসীমায় বাস করা মানুষগুলির ‘uncouth’ আচরণ ও কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে, তাদের দৈনন্দিন জীবনের যে রূপরেখা উঠে এসেছিল, সেখানে লেখকের কোনও অশ্লীলতার দায় বোধকরি ছিল না। এক্ষেত্রেও ছিটে থেকে শুরু করে ডিউটি অফিসার ইন্সপেক্টর জয়দ্বীপ কুমারের মুখের ভাষা, দুজনের কথোপকথন শুধু যে তাদের নিজেদের চরিত্রকে মেলে ধরেছে তাই না, গোটা হাওড়া স্টেশন ও স্টেশন সংলগ্ন মানুষজন, পরিবেশ, এমনকি জি. আর. পি’র কার্যকলাপের এক নিখুঁত জ্বলন্ত বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন অরিন্দম তার সাহস আর বলিষ্ঠ ভাবাবেগে।
তবে গল্পের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরার সময়, যে টুকরো টুকরো ছবি তৈরি করতে চেয়েছেন সেগুলো ভিসুয়াল মিডিয়ায় যতটা সহজ হয়, প্রিন্ট মিডিয়ায় অনুধাবন করতে মাঝে মাঝে একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছি, গল্পের গতিবিধি কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে বুঝতে বুঝতে অধৈর্য্য হয়েছি, তবে এও ঠিক প্রকারান্তরে এই বুঝতে না পারাটাও উত্তেজনার পারদকে উঠিয়ে দিয়েছে এক একসময়।
তবে গল্প পাঠের পরিসরে কতকগুলি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যার সঠিক উত্তর খুঁজে পাই নি।
প্রথমত,বলি বিষ্ণুপ্রসাদের সংলাপের মধ্যে দিয়েই কিন্তু ছিটের সাথে তার যোগসূত্র প্রথম থেকেই তাদের সম্পর্কের একটা আভাষ দিয়ে গেছে। এটা আরো পরে বোঝা গেলে আরো ভালো হত হয়ত।
দ্বিতীয়ত, ছিটের যাপনকথা হাওড়া স্টেশন এলাকায় যেভাবে দেখানো হয়েছে, তার পাশাপাশি কিন্তু মূল গল্পে তার বেড়ে ওঠার কোনো সূত্র গল্পে নেই।
তৃতীয়ত, যে HELIX নিয়ে এতো জল ঘোলা হয়েছে, আদপে তা কথার মারপ্যাঁচ নাকি তার আয়োজন সত্যিই ছিল কি ছিল না, সে বিষয়ে গল্পের শেষে আর উল্লেখ নেই।
চতুর্থত, যে প্রশান্ত দত্তের সপরিবার শিলং চলে যাবার উল্লেখ আছে, তার যাওয়া বা না যাওয়াটা কেন আর কিভাবে হয় নি তা স্পষ্ট নয়।
পঞ্চমত, আরশাদ আর আরমানের সাথে চন্দন সামলের জড়িয়ে থাকাটা, আশফাকুলের মৃত্যু আর নিরাময়বাবুর হত্যার সাথে মূল গল্পের কি যোগ সেটা আরো একটু বিস্তৃত হলে ভালো লাগত।
কোথাও কোথাও গল্প একটু অবিন্যস্ত লেগেছে। বিস্ফোরণের আগের পরের গল্প একটু সাজিয়ে নিলে বোধহয় পাঠকের আরো একটু সুবিধে হত, তবুও বলি এত বিস্তৃত আলোচনা না করলেও গল্পের বিষয়বস্তু এতটাই জোরালো,যে এসব চুলচেরা বিচারের পরোয়া করতেই লাগেনি পাঠের অবসরে। শুধু গোগ্রাসে পড়ে গেছি আর সবথেকে বড় ব্যাপার হল, লেখক শেষমেশ গল্পটিকে যেভাবে দেখাতে চেয়েছেন তার সাথে এগিয়ে চললে যে চমকটা পাঠক গল্পের পরিশেষে পাবেন তা সত্যিই অনবদ্য। আর সেই রোমাঞ্চকর অনুভুতি গল্পটা শেষ হবার পরে আরো একবার নতুন করে অবশ্যই ভাবাবে ।
তাই আবারো বলি, গল্পের এতো বিশ্লেষণে না গিয়ে, লেখকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত, গল্পের বাঁধুনি, চিত্রনাট্যের মত সংলাপ আর লেখার বলিষ্ঠতা সত্যিই প্রশংসনীয়। যা এককথায় গল্পটিকে সুখপাঠ্যের আখ্যা দেবে।
কৌতূহলপূর্ণ প্রচ্ছদ আর বইয়ের গুনগত মান প্রশংসার দাবী রাখে, তার জন্য প্রকাশক ‘দ্য কাফে টেবল’কে অফুরান ধন্যবাদ। আশা রাখি আগামীদিনে এই লেখকের কাছ থেকে আরও আরও এমন থ্রিলার পাব, যা আমাদের মত পাঠকদের ক্ষিদে ভীষণভাবে বাড়িয়ে দেবে। সবশেষে আরো একবার বলি, গল্পটি পড়তে পড়তে কোনোভাবেই মনে হবে না এটি’একটি মিথ্যে ঘটনা অবলম্বনে’।
Reviews
There are no reviews yet.