Description
কালজয়ী ঔপন্যাসিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ “দোজখনামা” পড়ে লিখেছিলেন এই সুন্দর লেখাটি। পাঠকদের জন্য রইল লেখাটি।
” … সহসা একদিন অতর্কিতে প্রতিদিনের রােববার -এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ‘দোজখনামা ‘ শিরোনামে একটি লেখায় চোখ পড়েছিল। তারপর আমার নিজেরই অগােচরে একটা প্রচণ্ড আলােড়ন ঘটে গেল। রবিশংকরকে আবিষ্কার করলাম এই উপমহাদেশে ইতিহাসের অন্ধকারে একটা মশালের মতো। আমরা আমাদের অকৃজ্ঞতা এবং পল্লবগ্রাহি ভাবনার আড়ালে দেশের যে মায়াময় ইতিবৃত্তকে পাশ কাটিয়ে এসেছি , রবিশংকর যেন সেই বিরাট বিশাল অন্ধকার কবরখানায় একখানা মশালে আলােয় একের পর এক কঙ্কালকে চিহ্নিত করছে যাঁরা এক সময় হিন্দু মুসলমান সমাজেরই একটি আশ্চর্যে সমন্বয় গড়ে তুলেছিলেন।
কিন্তু এভাবে বললেও তো আসলে অন্য একথা বলা হয়। কিন্তু রবিশংকর তাঁর আবেগদীপ্ত অনুসন্ধানে যাদের তুলে এনেছে তারা জীবন্ত মানুষ। আর জীবন্ত মানুষকে দেখাতে চাইলে তাদের আনতে হবে আখ্যানমালায় এবং সেই আখ্যান ফিকশনে। একসময় ‘ ফিকশন ‘ কথাটার জন্ম হয়েছিল , বাংলায় যাকে বলে গালগল্প , ঠিক সই শব্দার্থ সীমায়। ক্রমশ অর্থ বিভারে ‘ ফিকশন’ চলে এসেছে জীবন – ইতিহাসের পাকাপােক্ত সীমানায়। যাই হােক রবিশংকরের এই ফিকশনে উঠে এসেছেন মির্জা গালিব , সিপাহী বিদ্রোহের হতভাগ্য উপনায়ক বাহাদুর শাহ জাফর এবং তাদের সমকালীন অনেক মানুষ। এরপর রবিশংকর একটি বিচিত্র সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এই উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার মর্মান্তিক সময়ের এক নায়ক সাদাত হাসান মান্টো , এমন কি তার পাশাপাশি ইসমত চুগতাইকে উপন্যাসের চরিত্র করে। তারপরই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেছে। দুই শতকের ট্র্যাজিক নায়ক , উপনায়কদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্মোচন। উপন্যাস রচনার এক নতুন প্রকৌশল বাংলা সাহিত্যে আমরা এই প্রথম দেখতে পেলাম। কবরের অন্ধকার থেকে মির্জা গালিব আর সাদাত হাসান মান্টো পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছেন। সেই বাক্যালাপে উঠে আসছে জীবনের প্রতি প্রবল মমতা , প্রেম – ভালবাসার প্রতি সুতীব্র প্যাশন , আবার অন্যদিকে এসবের প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে আসছে জীবনের আর্ত হাহাকার আর যন্ত্রণার অনুভূতি। এযেন সেমেটিক ধর্মে উল্লেখিত মহাপ্রলয়ের পর বিশাল দিবসের পরিণামে একাধারে দোজখের যন্ত্রণা , বিভীষিকা এবং অন্যদিকে বেহেশতের পারিজাত – সুরভি।
এতাে আমাদের দেশেরই অতি প্রত্যক্ষ বাস্তব দুই শতকের কাহিনি। মির্জা গালিবের সময় এই দেশ ইংরেজ বাণিজ্য কোম্পানির করতলগত হয়েছিল। আট নয়শো বছর ধরে গড়ে ওঠা হিন্দু – মুসলিম কালচারের সমন্বয় ধারার উপর নির্মম আঘাত পড়েছিল। কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছি রবিশংকরের কলমের কৃতিত্বে। নিপুণ নিষ্ঠায় সে এই ভাঙনকে চিত্রিত করেছে। আবার পরবর্তী শতকে দেশভাগের ইতিহাসের সঙ্গে সাদাত হাসান মান্টোর জীবন চিত্রিত করে রবিশংকর আর একটি ঐতিহাসিক ট্র্যাজেজিকে রূপ দিয়েছে। প্রায় আড়াইশাে বছরের ইতিহাস এবং জীবন বৃত্তান্ত আমরা রক্তমাংসের কিছু খ্যাত অখ্যাত মানুষ – মানুষীর মধ্যে দেখতে পেয়ে আবেগ – আপ্লুত হয়েছি।
এই উপন্যাসে আমাদের অন্য সূত্রে জানা অনেক গল্পই মির্জা গালিব সাদাত হাসান মান্টো কিংবা অন্যান্য চরিত্রের মুখেও শুনতে পেলাম । এটা রবিশংকরের একেবারে নিজস্ব কল্পনা বলা চলবে না কারণ ওইসব প্রাচীন লােককথাগুলি একই চেহারায় কিংবা ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তুলনামূলক লােককথা এবং পুরাণকথা নিয়ে দীর্ঘদিন অধ্যয়ন করেছি তাই আমি নিশ্চিত যে রবিশংকরকে চেষ্টা করে কিছু বানাতে হয়নি। বরং এইসব লােককথা উপন্যাসের বৃত্তান্তের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে গেছে। আরও একটা বলবার কথা , গালিব – সাদাত বাক্যলাপের মধ্যে এই কাহিনিগুলি মিশে গিয়ে ‘দোজখনামা’ পাঠককে থেমে যাওয়ার সুযােগ দেয় না। সবচেয়ে বড় কথা এমন একটা গম্ভীর বিষয় পড়তে পাঠকের এতটুকুও ক্লান্তি আসে না।
রবিশংকর -এর ভাষার দক্ষতা সত্যিই অবাক করার মতাে ; কারণ এই উপন্যাসটি তরতরিয়ে পড়া যায়। অবিশ্বাস্য এর গতি । কোথাও থামতে ইচ্ছে করে না। এই আখ্যানে প্রেমের সঙ্গে অনিবার্যভাবে কামও আছে , যেন আলােকে দেখানাের জন্য মুঠোমুঠো অাঁধার রয়েছে । আর দুঃখ দারিদ্র , উপবাসী মানুষের আগ্রাসী ক্ষুধা মেটাতে নির্মম সব প্রয়াসের কথাও আছে। কিন্তু সর্বোপরি আছে জীবনের অনুরাগ। এসব বিষয় তাে মানুষের জীবনের চিরকালীন সঙ্কটের বিষয়। কবরের অন্ধকারে দোজখের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে একজন অমর কবি , অপর একজন অমর গল্পকারের সঙ্গে যে বাক্যালাপ করেছেন তা আমাদের মতাে পাঠকের কাছে বিস্ময়কর। আমি বাঙালি পাঠকদের কাছে আবেদন করতে চাই , তারা এই বিস্ময়কর আখ্যানটি পড়ুন। …”
(লেখাটি প্রকাশিত অহর্নিশ পত্রিকায়। সেপ্টেম্বর সংখ্যা। ২০১১)
Reviews
There are no reviews yet.