Description
বুলবুল মিয়াঁ আলো আঁধারিতে ঢাকা জাফরির পাশে দাঁড়িয়ে তার ছুঁচলো দাড়ি আর পাঁচপানওয়ালি টুপিসমেত মাথাটা দুলিয়ে বলল, “কিমাত আউর ভি বাকি হ্যায় হুজৌর!”
“আউর কিতনা?”
“আউর প্যাঁতিস হাজার রুপেয়া।”
“আরো পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা?” খাজাঞ্চি আসগর আলী খেঁকিয়ে উঠল, “শরাব পিকে আয়া হ্যায় ক্যা তু? এই তো পিছলি হফতায় পঞ্চাশ হাজার টাকা গুণে গুণে নিয়ে গেলি।”
বুলবুল মিয়াঁ অধোবদন হয়ে তিনবার আদাব ঠুকে বলল, “হাম ক্যা জানে সরকার। দত্তজী নে বোলা কি আউর প্যাঁতিস হাজার রুপেয়া লে আও। নবাবকে পাস উয়ো বাকি পড়ে হ্যায়।”
“তুই আর তোর ওই দত্তজীকে এবার হিড়হিড় করে টেনে আদালতে নিয়ে যাব বুরবক! আংরেজদের ডান্ডার পিটানি খেলে মালুম পড়বে। এক জোড়া ময়ূর বেচে পঞ্চাশ হাজার পেলি, তাও ভুখ মিটছে না। শালে শুয়ার কি আউলদ!”
নবাব একটু দূরে তাঁর সিংহাসনে বসেছিলেন। পাশে ওস্তাদ জাফর মহম্মদ একটা খেয়াল ধরেছিল। তাকে সারেঙ্গি ও তবলাতে যোগ্য সঙ্গত করছিল পারিষদরা।
অযোধ্যার নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্ এখন ষাটোর্ধ। নিজের মুলুক ছেড়ে এই বঙ্গভূমিতে এসেছেন প্রায় দুই দশক অতিক্রান্ত হতে চলল। এই দীর্ঘসময়ে দেশে রাজনৈতিক পালাবদল যেমন ঘটেছে, ইংরেজদের পায়ের মাটি ক্রমশই আরো মজবুত হয়েছে। কিন্তু নবাব সেদিকে দৃকপাতও করেননা। যেদিন প্রাণাধিক প্রিয় লক্ষনৌ ছেড়ে সুবিচারের আশায় কলকাতায় এসেছিলেন, সেদিন মনে ছিল অনেক আশা, হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করার স্বপ্ন। যত দিন গিয়েছে, সেই স্বপ্ন ফিকে হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছে ধূসর আকাশে। আর ততই বেশি করে তিনি নিজেকে গানবাজনায় ডুবিয়ে দিয়েছেন।
নবাব চোখ বুজে গভীর মনোযোগের সঙ্গে জাফর মহম্মদের খেয়াল শুনছিলেন। লয় ও তালের সঙ্গে তাঁর বহুমূল্য অঙ্গুরীয়খচিত আঙুলগুলো তিরতির করে ওঠানামা করছিল।
কিন্তু একটু দূরেই আসগর আলী আর বুলবুল মিয়াঁর উচ্চকিত কথোপথনে তাঁর বারবার তাল কেটে যাচ্ছিল। একসময় বেশ বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, “আহ আসগর! ইতনা শোর কিউ?”
আসগর আলী এদিকে ফিরে বলল, “গুস্তাকি মাফ কিজিয়ে জাহাঁপনা, লেকিন ইয়ে লোগ হামে বুদ্ধু বনারহে হ্যায়। পিছলে হফতো মে পোঁচাশ হাজার লেকে এক জোড়ি মুর দে গয়ি। ফিরসে আব বোল রহা হে কি প্যাঁতিস হাজার বাকি হ্যায়। হাম আপকো বোল রহা হ্যায় হুজৌর, উয়োহ নবকিশোর দত্ত বহত ঝুটা ইনসান হ্যায়।”
নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্ সঙ্গীতশ্রবণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় ক্রমশ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছিলেন। এবার প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “ঝুটা ইনসান নবকিশোর নয়, তুম! তোমাকে তো তিন-চারদিন আগেই বললাম, আমি এক জোড়া গিধ লিয়েছি। আজ বুলবুল মিয়াঁ তার কিমাত লিতে এসেছে, সাহি কিয়া হ্যায়। উসকো তংখা দে দো। ইতনি ছোটি সি বাতোমে ইতনা হল্লা মচারহে হো? গানা শুননে মে দিক্কত হো রহা হ্যায়, শরম আনা চাহিয়ে তুমহে!”
এক জোড়া গিধ! মানে শকুন?
খাজাঞ্চী আসগর আলী কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর সম্বিৎ ফিরে নবাবের পুনরায় সঙ্গীতে মনোনিবেশের আগেই তড়বড় করে বলল, “লেকিন হুজৌর! তহবিল মে নগদি তো নেই। এই মাহিনার পেনশন খতম। মাহিনা শেষ হতে আউর ভি এক হফতা বাকি।”
“আহ, ওইখানটা সাহি লাগছে না জাফর। মোহে তড়পত বিতি ঘড়ি পল ছিন ছিন। এই বিতি ঘড়ি’র খানটা ঠিক হচ্ছে না তোমার।” ওয়াজেদ আলী শাহ্ সুর করে ভুলটা ধরিয়ে দিতে দিতে আসগর আলীর বক্তব্যে থেমে গেলেন। তারপর ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “পেনশন খতম হো গিয়া?”
“জ্বী হুজৌর!” আসগর খাজাঞ্চী বলল।
“হুম।” ওয়াজেদ আলী সামান্য কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “এক কাম করো। সুলতানখানার দোতলায় পূব দিকের ঘরে দেখবে দুটো সোনে কা পালংক রয়েছে। উসমে সে এক বেচনে মে তো প্যাঁতিস হাজার আ হি যায়গা! ঠিক হ্যায়? আব যাও। আউর মুজকো তং মাত করো।”
সুলতানখানার প্রাসাদের দ্বিতলে যে দুটি সোনার পালঙ্ক রয়েছে, সেই দুটিই নবাবের পূর্বপুরুষ অযোধ্যার নবাব সাদত আলীর।
তার মধ্যে একটাকে বিক্রি করে সেই টাকায় কিনা কেনা হবে দুটো শকুন?
নবাবের পাগলামির সঙ্গে অষ্টপ্রহর পরিচয় থাকলেও এত বড় অপচয় খাজাঞ্চী আসগর আলী হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিল না। চোখ বড় বড় করে সে প্রথমে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নবাবের দিকে, তারপর বৃথা পরিশ্রম বুঝে সহমর্মিতার আশায় তাকাল পাশে বসে থাকা ওস্তাদ ও তার পারিষদদের দিকে।
কিন্তু তার দিকে কারুর দৃষ্টি নেই।
জাফর মহম্মদ আবার নতুন করে সুর ধরেছে,
“পিয়াবিন গুজর গেয়ি রয়েন মোহেকা
আজ হো নেহি আয়ে পীতম মোরী
মোহে তড়পত বিতি ঘড়ি পল ছিন ছিন …।”
Broto Chatterjee –
এর আগে সেই সময় ও পূর্ব পশ্চিম পড়েছি। নারাচ পড়তে পড়তে সেটার কথা মনে পড়ল । প্রচুর গবেষণার সাথে সাথে অপূর্ব গল্প বলার মুনশিয়ানা। টান টান ভিডিও সিরিজ দেখার মত , শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত বই ছেড়ে অন্য কাজ করার কোন উপায় ছিল না। ধন্যবাদ এই রকম একটা ঐতিহাসিক ঘটনা কল্পনা দিয়ে মুড়ে পরিবেশন করার জন্য।