Description
বইয়ের প্রথমেই আছে শিবরতন মিত্রের ( ১৮৭২-১৯৩৯-১২৭৮-১৩৪৫ ) বীরভূম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং অন্যান্য কয়েকটি লেখা। কে এই শিবরতন ? কলকাতার জেনারেল আসেমব্লীজের এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র শিবরতন সাময়িক পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু করেন কলকাতায় লেখা পড়ার সময়েই। কিন্তু মানুষটি ছিলেন পুরােপুরি অন্যধাতুতে গড়া। সিউড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন পারিবারিক গ্রন্থাগার রতন লাইব্রেরী। তাছাড়া বীরভূম সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা। বহু গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। কেবল রবীন্দ্রনাথ নয় , সেকালের সাহিত্য জগতের দিকপান মানুষদের সঙ্গে ছিল সুসম্পর্ক। রতন লাইব্রেরীতে অপরিমিত পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। এই অমূল্য সংগ্রহশালা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০ হাজার টাকায় কিনতে চেয়েছিলেন স্যর আশুতােষ। সেদিন তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হলেও , পরে বেশ কিছু পরিমাণ পুথি দেওয়া হয় বিশ্বভারতীর পুঁথিশালায়। পরে সমগ্র পুঁথিশালা চলে যায় , তাদের সংগ্রহে। অথচ কত পরিশ্রমে এই সব সংগৃহীত অমূল্য সম্পদ , পুঁথি , দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ , প্রাচীন মূর্তি , মুদ্রা , মানচিত্র সম্পর্কে সঠিক বিবরণ আজ আর জানা যায় না । শিবরতনের পুত্র “ বীরভূমের ইতিহাস ” গ্রন্থের লেখক গৌরীহর মিত্রের ( ১৯০১-১৯৪৭ ) সময়েও রতন লাইব্রেরীর দ্বার মুক্ত ছিল ছাত্র ও গবেষকদের জন্য। শিবরতনের নাতি ডঃ অমলেন্দু মিত্র এই গ্রন্থাগারকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি। ১৯৪৭ সালের আগেই গ্রন্থাগারের দরজা বন্ধ হয়ে যায় । পরবর্তী সময়ে গ্রন্থাগারের অমূল্য গ্রন্থ এবং পুঁথির বেশ কিছু পরিমাণ নিরুদ্দিষ্ট। কী মর্মান্তিক পরিণতি !
শিবরতনের বহু মূল্যবান প্রবন্ধ সেকালের সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল । কিন্তু গ্রন্থাকারে সেই সব রচনা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্র পাঠক শ্রী পার্থশঙ্খ মজুমদার বহু পরিশ্রমে শিবরতনের অগ্রন্থিত রচনার একটি সংকলন সম্পাদনা করেছেন। কয়েকটি লেখা সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হলেও , পরে কিছু পরিমার্জন করে বঙ্গীয় সাহিত্য সেবক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন । শিবরতন মিত্রের মূল্যবান রচনাগুলি সংগ্রহে আমরা এই সংকলনের ওপরে নির্ভর করেছি । শ্রী মজুমদারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই ।
এই অসাধারণ মানুষটি বীরভূমের ইতিহাস রচনার বৃহৎ পটভূমিতে অপরিহার্য । শিবরতনের পুত্র গৌরীহর আইনজীবী হলেও পিতার অনুপ্রেরণায় লেখার জগতে প্রবেশ করেন । সাময়িক পত্রপত্রিকায় লিখতেন । বেশ কয়েকটি বইও বেরিয়েছিল । তবে তার অমূল্য গ্রন্থ “ বীরভূমের ইতিহাস ” ১৩৪৩ ও ১৩৪৫ সালে প্রকাশিত হয় দুটি খণ্ডে । দুটি খণ্ড একত্রে অরুণ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ২০০৫ সালে । আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে গৌরীহরের এই বইটি ছিল মূল্যবান । যা আজও গুরুত্ব হারায়নি । গৌরীহরের গ্রন্থ কেবলমাত্র সেকালের রাজা রাজড়ার বিবরণ নয় । সেকালের জনজীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরবার চেষ্টা করেছিলেন । সমাজ জীবনের এমন চালচিত্র তেমন নিষ্ঠার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন সেকালে খুব কমজনই ।
হেতমপুর রাজবাড়ির বিদ্যোৎসাহী সন্তান মহিমানিরঞ্জন চক্রবর্তীর সম্পাদনায় তিনখণ্ডে বিপুল আয়তনে “ বীরভূম বিবরণ ” প্রকাশিত হয় । অসংখ্য ছবি ছিল বইটিতে । প্রকাশ করেছিলেন বীরভূম অনুসন্ধান সমিতির পক্ষে হরেকৃষ্ণ মুখােপাধ্যায় । রাজপরিবারের আর্থিক আনুকূল্যে ও সহযােগিতায় গ্রামের পর গ্রাম পরিক্রমা করে হরেকৃষ্ণ যেমন তথ্য সংগ্রহ করেন , তেমনি নানা পুঁথি ও অন্যান্য উপকরণও সংগ্রহ করেছিলেন । তাঁর এই দুঃসাধ্যকার্যের জন্য সাধুবাদ জানান পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং প্রাচ্য বিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু। কিন্তু এই বিপুল কলেবর গ্রন্থের মূল লেখক কে ছিলেন তা কোথাও উল্লেখ নেই। বর্তমান সংকলনে মহিমানিরঞ্জনের “ বীরভূম রাজবংশ ” গ্রন্থটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ভূমিকা থেকে জানা যায় স্বয়ং মহিমানিরঞ্জনই এই গ্রন্থের লেখক। তাঁকে সহযােগিতা করেন হেতমপুরের কিশােরীলাল সরকার ।
এর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে বেশ কয়েকটি মূল্যবান লেখা। বিগত শতবর্ষের মধ্যে মানুষের জীবনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন । বিদেশি শাসনমুক্ত হওয়ার পরবর্তী ৬০/৭০ বছরে পরিবর্তন এসেছে নানা দিক থেকে । জেলা বীরভূমের জনজীবনেও পড়েছে তার প্রভাব । কৃষিভিত্তিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি আজ বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত । জীবন ও জীবিকার সন্ধানে মানুষের সনাতন চিন্তাধারার কতই না রূপান্তর । পাঠশালা , চতুষ্পাঠী , চণ্ডীমণ্ডপ , হাটবাজার ছিল মানুষের কাছে অপরিহার্য , সেখানেও এসেছে ব্যাপক রূপান্তর । চণ্ডীমণ্ডপ আর হাট একদিন ছিল বাঙালির পক্ষে ভাবসম্মিলনের অসাধারণ ক্ষেত্র । আজ নেই চণ্ডীপণ্ডপের কোন চিহ্ন । হাট হয়ে গেছে মার্কেট । নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবহারও বদলেছে । প্রত্যন্ত গ্রামেও আধুনিকতার স্পর্শ । নতুন নতুন স্কুল কলেজ গ্রন্থাগার জেলার সর্বত্র । বড় বড় বাঁধ , নতুন নতুন রাস্তা গ্রামগুলিকে একমালায় বেঁধে দিয়েছে । চণ্ডীদাসের বীরভূমের কোথাও কোথাও কমােপলিটান সিটির স্বরূপ স্পষ্ট ।
কত দেবদেবী , মন্দির , মসজিদ ভক্ত সমাগমে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতাে , বৈচিত্র্যপূর্ণ লােকাচারের মধ্য দিয়ে বাঙালি জীবনের এক শ্বাশ্বতরূপ লালমাটির দেশকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করে রেখেছিল , আজ তা অনেক স্তিমিত । কেবল বীরভূম নয় বাংলার সর্বত্র ( পূর্ব পশ্চিম ) একই প্রতিচ্ছবি । প্রবাহিত জীবনের স্রোতধারা নানামুখী – সনাতন জীবনের ছাপ ক্রমশ আবছা হয়ে গেলেও , জীবন গড়ে উঠছে নতুনভাবে — রূপে ।
জৈন – বৌদ্ধ – নানা ধর্মমতের তীর্থক্ষেত্র প্লাবিত করেছিল এই লালমাটির দেশকে । তার স্মৃতিচিহ্ন স্মারক হয়ে আছে বীরভূমের বুক জুড়ে । কত রাজনৈতিক টানাপােড়েন , লড়াই – এর ঘনঘটায় উথাল – পাতাল হয়েছিল একদিন । কত শাসক , ধর্ম অভিযাত্রীদের অভিযানে সনাতন ধর্মচিন্তা বিধ্বস্ত হয়েছিল । তবুও বীরভূমের আধালিক মানচিত্রে লক্ষ্য করা যায় অজস্র মন্দির , আশ্রম , ধর্মসাধকের স্মৃতিবিজড়িতভবন , ছড়িয়ে আছে শহর ও গ্রাম জুড়ে । নানান সংস্কৃতির বিকাশ ও রূপান্তর ঘটেছে ।
সেই বিচিত্রময় জনজীবনের সংকলন এই গ্রন্থ।
Reviews
There are no reviews yet.