Description
মাঝেমধ্যে এমন এক-একটা বই হাতে আসে, যাদের নিয়ে কিছু লেখার ভাষা খুঁজে পাই না। মনে হয়, কীভাবে, কোন অবিশ্বাস্য কল্পনাশক্তি আর লেখনীর সমন্বয়ে রচিত হল এমন একটি লেখা? সে-সব লেখা এতটাই ব্যতিক্রমী, এতটাই ঐশ্বর্যমণ্ডিত, আর এতটাই ধারালো, যে নিজের যাবতীয় তুচ্ছতা আর গ্লানিও নগণ্য হয়ে যায় তার সামনে। মাথায় থেকে যায় শব্দ, বাক্য, যতিচিহ্নের মতো আপাত নীরস বস্তু দিয়ে গড়ে তোলা এক জাদুকরি দুনিয়া— যেখানে রণ, রক্ত, সফলতা… এমন সবকিছু ছাপিয়ে বিচিত্র আলো-ছায়ার নকশা সৃষ্টি করে চলে ভালো আর কালো, মনুষ্যত্ব আর অন্য কিছু।
অসিশপ্ত তেমনই একটি বই।
এই কাহিনির পটভূমি অম্বালিকা নামক একটি গ্রহ। সেখানকার মূল বাসিন্দা, যাদের মানুষ ‘ভিন্নর’ নামে চেনে, হারিয়ে গেছে বহুযুগ আছে। কিন্তু তাদের ফেলে রাখা প্রযুক্তি আর বাঁচার অদম্য ইচ্ছেকে সম্বল করে সেখানে মানুষ গড়ে তুলেছে বিভিন্ন বসতি।
এই গ্রহের পরিবেশ রীতিমতো বিপদসঙ্কুল। সহসা তেমনই এক বিপদের সামনে পড়ে নরম মনের রজত জড়বৎ হয়ে গেছিল। তার পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ। বাবা’র আদেশে তলোয়ারবাজি শেখার জন্য এক আখড়ায় যোগ দেয় রজত— যাতে সে ‘সত্যিকারের পুরুষ’ হয়ে উঠতে পারে। যন্ত্রণাদায়ক সেই শিক্ষারই এক অধ্যায়ের পর হতাশ রজত অপ্রত্যাশিতভাবে খুঁজে পেয়েছিল ভিন্নরদের একটি বাংকার। কিন্তু সেখানে সে নতুন কোনো প্রযুক্তি পায়নি। তার বদলে তাকে খুঁজে পেয়েছিল কেউ… বা কিছু।
তারপরেই অসিসর্বস্ব এক ভয়াবহ পথের পথিক হয় রজত। আখড়া, বাড়ি, হোমিগঞ্জ, হকিন্সাবাদ, দৌলতনগর— সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তার অসির দাপট। আর তারই সঙ্গে, ক্রমেই মানবিকতা হারিয়ে ফেলতে থাকা রিপুসর্বস্ব মানুষদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে সর্বত্র বিস্তৃত হয় এক অন্যরকম অন্ধকার।
তারপর কী হল? অসির অভিশাপ কি গোটা অম্বালিকা-কেই ঠেলে দিল ধ্বংসের পথে? নাকি কোনো গোপন আগুন শুদ্ধ করে দিল তাকে?
এই শ্বাসরোধী কাহিনিই অসিশপ্ত। প্রথাগত আদি-মধ্য-অন্তের কাঠামোর মধ্যে ন্যারেটিভকে আবদ্ধ রেখেও এতে লেখক সামগ্রিকভাবে যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, তা আক্ষরিক অর্থে অভাবনীয়।
কেন?
প্রথমত, এর ভাষা অন্যরকম। ভিন্ন মানসিকতার মানুষের বাচনভঙ্গি বোঝানোর জন্য, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির কথায় তাদের পেশার প্রভাব স্পষ্ট করার জন্য, সর্বোপরি ক্ষয়িষ্ণু ও বিকৃত এক সমাজের বিত্তীয় বৈভবের দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য এতে বহু ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তার একটিও দুর্বোধ্য নয়; তা সত্বেও সেগুলোর এই গ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে আলাদাভাবে। ফলে এটি পড়ার সময় চরিত্রদের কার্যকলাপ শুধু পড়া নয়, প্রায় শোনার মতোই অভিজ্ঞতা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, লেখকের ভুবন-নির্মাণ বা ওয়ার্ল্ড-বিল্ডিং নৈপুণ্য স্রেফ লা-জবাব। অম্বালিকার মানুষজনই শুধু নয়, আকাশ-বাতাস, জঙ্গল, পশু, বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ হোক বা দেশি মদের নেশা— প্রতিটি খুঁটিনাটি চোখের সামনে একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আক্ষরিক অর্থেই এই বই পড়া হয়ে উঠেছে এক অবগাহন— যেখানে আশপাশ থেকে তথাকথিত স্থান-কাল-পাত্র মুছে গিয়ে জেগে থাকে শুধু অম্বালিকা আর তার নানা চরিত্র ও ঘটনা।
তৃতীয়ত, অসিযুদ্ধের নানা কৌশল, তাদের প্রতিটি নড়াচড়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দর্শন, সর্বোপরি এক যোদ্ধার মনোজগতের নানা দিক, তার পূর্ণতা ও শূন্যতা— এগুলো এর আগে বাংলায় কোনো বইয়ে পড়ার সুযোগই হয়নি। যে লড়াইগুলো এখানে দেখানো হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিতে যুযুধানদের পায়ের চলন, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, তলোয়ার ধরার পদ্ধতি, এমনকি আঘাতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই তথ্যগুলো একবারও অতিরিক্ত বা ইনফোডাম্পিং বলে মনে হয়নি! বরং এই রুদ্ধশ্বাস গল্পেও এমন কথা বা প্রসঙ্গগুলো যখন এসেছে, তখন মনে হয়েছে যে লেখক ঢিমে আঁচে আমাদের ভাপাচ্ছেন।
চতুর্থত, একটিও অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার না করে এই গল্পে মনুষ্যত্বের ক্রমবিলোপ আর রক্ষণাবেক্ষণ— দুটিই দেখিয়েছেন লেখক। রক্ত ও আর্তনাদের মধ্যেই দু’ফোঁটা চোখের জল বা হালকা হাসির সেই প্রয়োগ বুঝিয়ে দিয়েছে, লেখক অম্বালিকা তথা তার বাসিন্দাদের ওপর থেকে সবটুকু বিশ্বাস এখনও হারাননি।
পঞ্চমত, এই ঘন-সন্নিবিষ্ট বিবরণ ও ঘটনা-দুর্ঘটনায় ভরা কাহিনিটি শেষ না করে থামা প্রায় অসম্ভব ছিল। আবারও বলি, বর্ণনা ও সংলাপ, গতি ও মননের মিশ্রণে এটি পড়া এমনই এক অভিজ্ঞতা ছিল যাকে সিনেমা দেখার সঙ্গেই একমাত্র তুলনা করা চলে।
এই বইয়ের কিছু কি আমার খারাপ লেগেছে?
মাথা খারাপ! এমন একটা লেখা বাংলায় পড়তে পেয়েছি— এজন্যই নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করছি।
বইটির ছাপা ও লে-আউট দুর্দান্ত। ভেতরে মানচিত্রগুলো থাকায় অম্বালিকাকে নিজের মতো করে ভেবে নেওয়া সহজতর হয়েছে।
ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের দুর্ধর্ষ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ বইটির মধ্যে নিহিত সর্বনাশের বীজ বুকে নিয়ে ঝলসে ওঠা এক তরবারির ধারালো ও বিষাক্ত ভাবটিকে স্পষ্ট করে তুলেছে— এও আলাদাভাবে স্বীকার্য।
সব মিলিয়ে বলব, কল্পবিজ্ঞান বা অ্যাকশন থ্রিলারের গণ্ডি পেরিয়ে এ বই এক দুর্গম পথ ধরে মহাযাত্রার কথা বলেছে। সে পথের একদিকে আছে অমানব, অবমানব, আর লোভের বশে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলা এক চরিত্র; অন্যদিকে আছে ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে মনুষ্যত্বের ক্ষীণ শিখাটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা ক’জন।
Reviews
There are no reviews yet.