Description
ঘটনাচক্রে কিংবা নিয়তির প্রবল টানে অন্ধকার জগতে ঢুকে পড়ে সে। তারপর শুরু হয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, নিজেকে আড়ালে রাখার সংগ্রাম। সবার মাঝে থাকলেও খুব কম মানুষই তাকে চেনে আর তার
সম্পর্কে জানে আরও কম। স্লাইপার-স্কোপে চোখ রেখে খুঁজে নেয় টার্গেট। অলক্ষ্যে আর অগোচরে আঘাত হানে সে একজন অগোচরা হয়ে। একেকটা বুলেট নিশ্চিত করে তার অন্তরাল, তার অস্তিত্ব আর কাঙ্ক্ষিত মুক্তি!
ফাঁকা মাঠ পেয়ে বিধুদা ব্যস্ত হয়ে গেল পুরান ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে।
অনায়াসেই সেটা করতে পেরেছিল দাদা, খুব একটা কষ্টও করতে হয়নি তাকে। দু’ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও আমাকে দিয়ে নতুন কোনো কাজ আর করায়নি।
তবে গেসু বসে থাকেনি, তাকে একটা কাজ দিয়েছিল দাদা। নিজের দলের ভেতরে খলিল নামে এক বেঈমানকে চিহ্নিত করেছিল সে। জানামতে, ছেলেটা বিশ্বস্তই ছিল কিন্তু দাদার সমস্ত সন্দেহ গিয়ে পড়লো তার উপরে। কোত্থেকে যেন গেসু জানতে পেরেছিল, সজল ভাইয়ের খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে খলিল মেলামেশা করে। ওর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু জানার দরকার পড়েনি। হাতজোর করে খলিল না কি দাদাকে বলেছিল, ঐ ছেলের সঙ্গে সে স্কুলে পড়েছে, তাদের সম্পর্কটা নিছক বন্ধুত্বের, এর সঙ্গে সজলের কোনো সম্পর্ক নেই। সে কোনো রকম বেঈমানি করেনি দাদার সাথে।
কিন্তু অপরাধ জগতের অঙ্ক অন্য রকম। জটিল আর নির্মম এখানকার হিসেব-নিকেশ। কারো সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গেলেও খুব সতর্ক থাকতে হয়, সেটা যত নির্দোষ সম্পর্কই হোক না কেন।
আমার মনে নানান প্রশ্ন। দাদা যে সজল ভাইকে মারবে, এটা কি খলিল জানতো?
“না জানলে লিক হইলো ক্যামতে?” গেসুর সোজাসাপ্টা জবাব।
দ্বিমত পোষণ করলাম আমি। বিধুদা নিজের মুখেই বলেছে, সে বাদে আমি আর গেসু ছাড়া এটা কেউ জানে না।
কাঁধ তুলেছিল গেসু। “কী জানি! দাদাই ভালা জানে। আমাগো এইটা নিয়া মাথা ঘামানোর দরকার নাই।”
কিন্তু আমি মাথা ঘামাতে শুরু করলাম। নিছক সন্দেহের বশে নিজদলের বিশ্বস্ত একজনকে যদি খুন করা যেতে পারে, তবে আমি কোন ছাড়! আমার প্রতি সামান্য সন্দেহ তৈরি হলে তো খলিলের পরিণতি বরণ করতে হবে!
এই হত্যাকাণ্ড ভাবিয়ে তুলল আমাকে, কোনোভাবেই মাথা থেকে তাড়াতে পারলাম না। এরকম সময় ছোট্ট একটা ঘটনা দেখে ফেললাম আমি, আর এটাই আমাকে সবকিছু বুঝতে সাহায্য করেছিল। এটা নিয়ে যদি গভীরভাবে না ভাবতাম তাহলে আজ আমি সাড়ে তিনহাত মাটির নিচে থাকতাম।
দু-তিন দিন পর গেসু জানালো, দাদা আমাকে দেখা করতে বলেছে, আমি যেন আগামিকাল বিকেলে তার বাড়িতে যাই। কথাটা শুনে বুক কেঁপে উঠল আমার। গেসুর বলার ভঙ্গি কেমন জানি লেগেছিল। পুরান ঢাকায় থাকি, বৈঠকি খুনের কথা আমার অজানা নয়। এক সময় এখানকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একচ্ছত্র অধিপতি আকবর শেঠ টার্গেটকে বৈঠক করার কথা বলে ডেকে নিয়ে হত্যা করতো।
(অগোচরার অংশবিশেষ)
নদীর ওপারে, কেরানিগঞ্জের এক মাফিয়া ডন মানিককে সরিয়ে দিতে চাইছে দাদা। কোথায়, কীভাবে কী করতে হবে, সবই বলে দিল, সঙ্গে দিয়ে দিল তার বিশ্বস্ত সহযোগী নাটকা গেসুকে। এই গিয়াসুদ্দিন আমাকে নিয়ে গেল ওয়ারির একটি ছয়তলা বাড়ির পাঁচতলার খালি ফ্ল্যাটে। ওখানকার পশ্চিমমুখী জানালা দিয়ে মানিকের বাড়ির মেন গেটটা দেখা যায়। ওই বাড়িটা যে আসলে মানিকের ছিল সেটা জানত হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ, তাদের মধ্যে বিধুদাও একজন। গেসুর কাছ থেকেই জানতে পারলাম, ওখানে থাকে মানিকের রক্ষিতা শায়লা। মানিক মাঝেমাঝে আসে সেই বাড়িতে, রাত কাটিয়ে চলে যায় সকালে, সঙ্গে থাকে সশস্ত্র দেহরক্ষী।
আপাতদৃষ্টিতে কাজটা সহজ মনে হলেও বিরাট বড়ো ঝুঁকি ছিল। পাঁচতলার জানালা দিয়ে গুলি করামাত্রই মানিকের দেহরক্ষীরা মাজল ফ্ল্যাশ দেখে বুঝে যাবে। কোত্থেকে ওটা করা হয়েছে, তখন আর পাঁচতলা থেকে নেমে পালানো সম্ভব হবে। না।
এমন আশঙ্কার কথা শুনে নাটকা গেসু হেসে ফেলল। ‘এইটা লইয়া তোমারে চিন্তা করতে অইবো না। দাদায় সব ব্যবস্থা করছে।’
কিন্তু কী ব্যবস্থা, আমাকে খুলে বলল না সে।
রাত ন-টার পরই ঘরের সব বাতি নিভিয়ে জানালার কাছে রাইফেলটা স্ট্যান্ডের উপর রেখে অপেক্ষা করতে থাকলাম। গেসু আমার সঙ্গেই ছিল, প্রচুর খাবার আর সিগারেট নিয়ে বসেছিল সে। আমার অবশ্য খাওয়ার রুচি চলে গিয়েছিল। একটু পর এক আদম সন্তানকে হত্যা করতে যাচ্ছি — জীবনে প্রথমবারের মতো। হোক না সে ভয়ংকর মাফিয়া, দশ-বারোটি হত্যাকাণ্ডের হোতা স্মাগলিং থেকে শুরু করে। জমিজমার দখলদার।
আমি জানতাম এই মানিকের সঙ্গে বিষুদার সম্পর্ক বেশ ভালো, কিন্তু হুট করে এতটা খারাপ হল কেন?
সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে নাটকা গেসু মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিল, “সম্পর্ক খারাপ অইবো ক্যালা?… ভালাই আছে। এত কিছু তোমার জানোনের দরকার নাই।” সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল বিধুদার ডানহাত। “দাদা কইছে মারতে, তুমি মারবা… কিসসা খতম।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না, নজর দিলাম মানিকের বাড়ির মেন গেটের দিকে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর রাত এগারোটার একটু আগে সাদা রঙের একটি পাজেরো জিপ এসে থামল সেই বাড়ির সামনে। প্রথমে গাড়ির সামনের দরজা খুলে নেমে এল জাদরেল চেহারার এক দেহরক্ষী। যেমন লম্বা তেমনি পেটানো শরীর লোকটার। পেছনের সিট থেকে নেমে এল দ্বিতীয় দেহরক্ষী। আগের জনের মতোই শারীরিক গড়ন তার। চারপাশে তাকিয়ে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা কাউকে ইশারা করল
সে। গাড়ি থেকে নেমে এল গাঁট্টাগোট্টা আর নাদুস-নুদুস শরীরের মানিক। টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে সবটাই দেখছিলাম আমি। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে রাইফেলে একটা সাইলেন্সারও সংযোজিত করেছি এই মিশনের জন্য।
বাড়ির দারোয়ান গাড়ির হর্ন শুনে গেট খুলে দিল। মানিক যে-ই না গেট দিয়ে ঢুকবে অমনি প্রথম গুলিটা করলাম আমি। একেবারে তার ঘাড়ের পেছন দিকে। জানতাম, উপর থেকে গুলিটা করেছি বলে মানিকের হৃৎপিণ্ড কিংবা ফুসফুস বিদীর্ণ করে ফেলবে বুলেট।
গাঁট্টাগোট্টা দেহটা নিয়ে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কেরানিগঞ্জের
শেঠ। তার দুজন দেহরক্ষী কিছু বুঝে ওঠার আগেই আশপাশ থেকে গোলাগুলি
আর বোমার শব্দ হতে লাগল।
‘আর-একটা শট লও!’ তাগাদা দিল আমার পাশে থাকা নাটকা গেসু । ঢোক গিলে জীবনের প্রথম খুনটা নিশ্চিত করলাম দ্বিতীয়বার ট্রিগার চেপে। এবার ভূপাতিত মানিকের মাথা লক্ষ্য করে মারলেও গুলিটা গিয়ে লাগল তার ডান কানের নীচে। মাথার একপাশ প্রায় উড়ে গেল, রক্তের ছটা লাগল গেটে। নাদুসনুদুস শরীরটা বার দুয়েক কাপুনি দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল চিরতরের জন্য ওদিকে গোলাগুলি আর ককটেল বিস্ফোরিত হচ্ছে সমানে।
কারা গুলি করছে? বোমা মারছে? মুচকি হাসল গেসু। ‘বোম মুক্তার।’
পুরোনো ঢাকায় তখন ককটেল বানানোর জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে বোম মুক্তার নামের এক যুবক। শুধু বানানোই না, সেগুলো ঠিকমতো মারতেও পটু ছিল সে। বিকট আওয়াজ শুনে পুলিশও বুঝে যেত এটা বোম মুক্তারের বানানো ককটেল।
(অগোচরার অংশবিশেষ)
Reviews
There are no reviews yet.