Manoj Basu
বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মনোজ বসু। বাংলার মাটি, মানুষ, আকাশ, জলপাই রংয়ের গাছ গাছালি, গঙ্গা পদ্মার শব্দ নৈশব্দের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে মনোজ বসু সাহিত্যকর্ম।
মনোজ বসুর গল্প ও উপন্যাস হৃদয় দাক্ষিণ্যে আবেগ বিহবল। স্কুলে পড়াকালীন কয়েকজন উৎসাহী বন্ধু মিলে একটি হস্ত মুদ্রিত পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর পর তিনি ‘বিকাশ’ পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। ক্ষুদ্রাকার ডিমাই সাইজের পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই মনোজ বসু লিখতে শুরু করেন। পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যায় লেখকের একটি গল্প প্রকাশিত হয়। গল্পটির নাম ‘গৃহহারা’, লেখক মনোজ মোহন বসু। ‘বাঁশরী’র পৃষ্ঠাতেও ঐ নামে তাঁর প্রথম আত্নপ্রকাশ। পিতৃ প্রদত্ত নামের মধ্যপদ লোপ করে পরে তিনি মনোজ বসু হলেন। ‘নতুন মানুষ’ (বিচিত্রা কার্ত্তিক, ১৩৩৭) প্রথম পদক্ষেপ হলেও প্রকৃতপক্ষে ‘বাঘ’-ই মনোজ বসুর কৃতিত্বের পরিচায়ক-এতেই তাঁর সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা। ‘বাঘ’ গল্পটি সম্পর্কে বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায় তাঁর উচ্ছাসিত প্রশংসা করেছেন। বিভূতি ভূষণ কবি জসীম উদ্দীনের সঙ্গে তাঁর ছিল আনত্মরিক সম্পর্ক।
গল্পের পাশাপশি প্রকাশিত হচ্ছিল মনোজ বসুর সৃষ্টিধর্মী কবিতা। তাঁর প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘গেপন কথা’ হেমলতা দেবী সম্পাদিত মেয়েদের কাগজ ‘বঙ্গলক্ষী’ তে ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়।
সই কিবা কর, কারোও কবি না-কহিব তব সে কথা।
বিল কিনারায় উড়ে চলেছিল সাদা সাদা বকগুলি
মেঘের গলায় সাতনরী – হায় যায় যেন দুলি দুলি।
তুলসীতলায় সন্ধ্যার দীপ বাতাসে কাঁপিয়ে মরে।
এত বড় বাড়ি – কেউ কোথা নাই, দু’জনে একেলা ঘরে।
দূরে বিয়াবাড়ি কত কোলাহল, বাজিতেছে ঢোল কাঁশি।
ও কহে তখন সেই পুরাতন, ভালবাসি, ভালবাসি।
গুরু সদয় দত্ত প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলার শক্তি’ পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে। মনোজ বসু এই পত্রিকাটি সম্পাদনাসহ ‘সাহিত্যের খবর’ পত্রিকাটিও সম্পাদনা করতেন। তিনি ‘বাংলা সাহিত্য একাডেমীর’ (পশ্চিম বাংলা) সভাপতি মন্ডলীর অন্যতম এবং কলকাতার নিখিল ভারত লেখক সম্মেলন ও নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সর্ব ভারতীয় ও আঞ্চলিক একাধিক সম্মেলনে পৌরহিত্য করা ছাড়াও অসংখ্য সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংস্থার পৃষ্ঠপেষকতা করেছেন।
জীবনে দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও কখনও থেমে থাকেনি মনোজ বাসুর সাহিত্যচর্চা। মনোজ বসুর সাহিত্য চিন্তা তাঁর জীবন র্চায় একান্ত অনুগামী হয়ে দেখা দিয়েছিল। জীবন অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছে সাহিত্য চিন্তার প্রতিফলন। ‘আমি সম্রাট’, ‘সেই গ্রাম সেইসব মানুষ’, নিশিটুকুম্ব, ‘নবীন যাত্রা’, ‘একদা নিশিথকালে’, ‘কিংশুক’, ‘মায়াকন্যা’, ‘বন কেটে বসত’, ‘রূপবতী’, ‘সেতুবন্ধ’, ‘ঝিলমিল’ মনোজ বসুর রচনাবলী।
তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ফসল জমা হয়ে আছে ‘আগস্ট ১৯৪২’, ‘ভুলিনাই’, ‘সৈনিক’, ‘বাঁশের কেল্লা’ এই সকল রাজনৈতিক উপন্যাসগুলিতে। মনোজ বসু ভারতীয় সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় তাঁর লিখিত ‘ভ্রমণ কাহিনী’, ‘চীন দেখে এলাম’, ‘সোভিয়েতের দেশে দেশে’, ‘নতুন ইউরোপ নতুন মানুষ’, ‘পথচলি’ বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ হিন্দী, ইংরেজী, গুজরাটি, মারাঠা, মালয়ালাম ভাষায় মুদ্রিত হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি গ্রন্থ চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।